ঐতিহাসিক “বড়াইবাড়ী দিবস “আজ

প্রকাশিত: ৩:২৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০২৫

লাল সবুজের দেশ :
২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভোরে বিএসএফ নগ্ন হামলা চালিয়েছিল বড়াইবাড়ি গ্রাম এবং বিজিবি ক্যাম্প দখলের। হামলার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিল বিডিআর/বিজিবি আর রৌমারী অঞ্চলের বীর জনতা। ১৬ জনের লাশ এবং জীবিত দুজন আটককৃত বিএসএফ ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল বিএসএফ। ৩ জন বীর বিডিআর সৈনিক শাহাদাত বরণ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে। বিএসএফরা যে বেআইনীভাবে বড়াইবাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে প্রবেশ করেছিল তা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরের ইতিহাসে এ এক জঘন্যতম অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। দেশ স্বাধীনের পর অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ী এলাকা পাদুয়ার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পসহ দু’শ ৩০ একর ভূমি বিএসএফ অপদখল করে নেয় এবং ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যরা এই ক্যাম্প দখলে রাখে।

ক্যাম্পের আশপাশে বাংলাদেশের জনগণের বসবাস রয়েছে এবং তাদের উপর অমানবিক নির্যাতনও চালিয়ে আসছিল। ১৯৯৯ সালে থেকে বিডিআর-এর উপ-মহাপরিচালক ও বিএসএফ-এর আইজি পর্যায়ে প্রতিটি সভায় ক্যাম্প ও পাদুয়া গ্রামটি অপদখলীয় মুক্ত নিয়ে আলোচনা হয়।

১৯৯৯ সালের মাঝামাঝিতে সিলেট সীমান্তের লাতু এলাকা থেকে কয়েকজন বিডিআর সদস্যকে বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর আজিজুর রহমান। বিডিআর এ সময় পাদুয়া দখলে নিতে বিএসএফকে হুশিয়ারি জানিয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে বিডিআর ১৫ এপ্রিল ২০০১ রাতে পাদুয়া গ্রাম পুনরুদ্ধার করে এবং সেখানে ৩টি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে।

এ গ্রামটি পুনরুদ্ধাারের সময় কোন পক্ষ থেকে গোলাগুলি হয়নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিএসএফ পাদুয়া ঘটনার মাত্র তিনদিনের মধ্যে রৌমারী সদর ইউনিয়নের বড়াইবাড়ী গ্রাম ও ক্যাম্প দখলের অপচেষ্টা চালায়।

বিএসএফ’রা ১৬ এপ্রিল দুপুরে বড়াইবাড়ি অপারেশন পরিকল্পনা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহেন্দগঞ্জ-কামালপুর পাকা সড়ক নির্মাণ সহজ করা এবং বড়াইবাড়ির চার কিলোমিটার অতি উর্বর জমি ভারতীয়দের দখলে আনা। ধুবরী, মহেন্দ্রগঞ্জ, গৌহাটি থেকে রাতেই তিন প্লাটুন ক্যাটস আই কমান্ডো ও দু’শর বেশি অতিরিক্ত বিএসএফ এসে গোপনে অবস্থান নেয় মাইনকারচর ক্যাম্পের আশেপাশে। প্রস্তত রাখে মর্টার, কামান, মেশিনগান ও সাঁজোয়া যান।

বাংলাদেশের বড়াইবাড়ি, হিজলামারী, খেওয়ারচর, বিডিআর ক্যাম্পগুলো যেমন দুর্গম তেমনি অনুন্নত। সীমান্তে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার না থাকায় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের বিডিআর’রা বিএসএফ-এর আক্রমণের প্রস্ততি আগে বুঝতে পারেনি। কিন্তু অতর্কিত ভাবে সেই ১৮ই এপ্রিল কাঁটাতারের বেড়ার মাঝে পূর্ব অংশের গেট দিয়ে রাত ৩টার দিকে ভারতীয় কমান্ডো, সেনা ও বিএসএফ-এর প্রায় চারশত সদস্যের যৌথ-বাহিনী ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে ঢুকে পড়ে বড়াইবাড়ী সীমানায়।

শুকিয়ে যাওয়া খাল দিয়ে তারা ক্রস করে এগিয়ে তিনদিক থেকে বড়াইবাড়ী ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্ততি নেয়। গেট পেরিয়ে ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ বড়াইবাড়ীতে ঢুকে পড়ার দৃশ্যটি দেখে ফেলে ঐ গ্রামের মিনহাজ। সেই দিন ভোর সাড়ে ৩টায় ধানক্ষেতে সেচ দিতে গিয়ে মিনহাজ কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে সারি সারি সৈন্য আসতে দেখতে পায় এবং বিএসএফরা বড়াইবাড়ি ক্যম্পটি কোথায় জানতে চাইলে অন্য একটি বাড়ি দেখে দিয়ে তখনই সে দৌড়ে খবর দেয় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পে।

সাথে সাথে প্রস্তুতি নিয়ে এবং ওয়্যারলেসে খবর চলে যায় পার্শ্ববর্তী হিজলমারী ও খেওয়ারচর ক্যাম্পে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে পূর্বদিক থেকে বিএসএফ বড়াইবাড়ী ক্যাম্পে গুলীবর্ষণ যখন শুরু করে তখন প্রথম ১০ মিনিট বিডিআররা ছিল নিশ্চুপ।

ভারতীয় বাহিনী এ ঘটনায় মনে করেছিল বিডিআররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তাদের একটি বাহিনী পশ্চিম গ্রামের দিক থেকে একটি দল ক্যাম্পের দিকে অসতর্কভাবে এগুতে শুরু করলে বড়াইবাড়ী বিওপি থেকে বিডিআর-এর চারটি মেশিনগান একযোগে গুলীবর্ষণ শুরু করে। আকস্মাৎ এ আক্রমণে ভারতীয় বাহিনী হতচকিত হয়ে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। তারা ভেবে বসে উল্টো দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে।

এই সময় বিডিআর এর ল্যান্স নায়ক ওহিদুজ্জামানসহ ৩ জন জোয়ান ও ১৬ জন বিএসএফ নিহত হয়। এরপর হিজলমারী ও খেওয়ারচর বিওপি থেকে বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের ১০ জন বিডিআর-এর সাথে আরো ১৬ জন বিডিআর যোগ দেন ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। ভারতীয় বাহিনী সকাল ১০টা পর্যন্ত বিওপি’র দু’শ গজ দূরে বাংলাদেশের সীমানায় ছিল।

তৎকালিন জামালপুর থেকে ৩৩ রাইফেল ব্যাটেলিয়ান-এর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল এস জামান-এর নেতৃত্বে অতিরিক্ত বিডিআর বড়াইবাড়ীতে পৌঁছার পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে ওপারে পালিয়ে যায়। এরপর লাগাতার প্রায় দু’দিন চলে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলীবিনিময়। এই সংঘর্ষে বিএসএফ আরো নিহত হয়েছে বলে জানা গেলেও নিশ্চিতভাবে সংখ্যা জানা যায়নি।

নিহত হন মাহফুজার রহমান এবং আঃ কাদের নামক আরো দু’জন বিডিআর। আহত হন হাবিলদার আঃ গনি, সিপাহী আঃ রহমান, সিপাহী জাহেদুর, দুলাল বড়ুয়া, নজরুল ইসলাম, আওলাদ হোসেন, নূরুল ইসলাম প্রমুখ। গ্রামবাসীদের মধ্যে আহত হন শেখ সাদী(৪), বিলকিস খাতুন(১২), মকবুল হোসেন(৬০), ছমিরন নেছা(৫৫) এবং গোলাম মোস্তফা(৩৫)। গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে অক্ষয় কুমার ও বিমল প্রসাদ নামক দু’জন বিএসএফ সদস্য।

পরে বিডিআর উদ্ধার করে মোট ১৬ জন বিএসএফ-এর লাশ। যা পরে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিডিআর আরও উদ্ধার করে দু’টি এলএমজি, ১৫টি এসএলআরসহ গুলী, ম্যাগাজিন, জুতা, ওয়্যারলেস সেট প্রভৃতি। এগুলো সবই বিএসএফ-এর। পরবর্তীতে উচ্চপর্যায়ের চাপে ফ্ল্যাগ মিটিং-এর মাধ্যমে বন্ধ হয় সংঘর্ষ। ঐ সময়ে ঐ সীমান্তের আশপাশের প্রায় ৩০টি গ্রামের ৩৫ হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এদের ভোগ করতে হয় অবর্ণনীয় কষ্ট ও দুর্ভোগ।

২০ এপ্রিল বিকেলে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় তৎকালিন পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, ‘সিলেটের তামাবিল এলাকার পাদুয়া থেকে বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর-এর ঘেরাও তুলে নেয়া হয়েছে। ভারতও তার বিরোধপূর্ণ রাস্তাটি ভেঙ্গে দেয় এবং দুদেশের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সাপেক্ষে সংঘাতের সমাপ্তি ঘটে।